অন্যায় অত্যাচারের বিস্তৃত পরিমণ্ডলে ঘনকৃষ্ণ মেঘমালার বুক চিরে আরও একটি জ্যোতিষ্মান বিদ্যুতের চমকে আরব গগণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল । আরব জাহানের অন্যতম তেজস্বী পুরুষ 'উমার বিন খাত্তাব' ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন । তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ বর্ষে, হামযাহ (রা:) এর ইসলাম গ্রহণের মাত্র ৩ দিন পর । নাবী কারীম (সা:) উমার (রা:) এর ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করেছিলেন ।
ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা:) হতে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং একে বিশুদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন । অনুরূপভাবে তাবারাণী ইবনে মাসঊদ (রা:) এবং আনাসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা:) বলতেন: "হে আল্লাহ্! উমার বিন খাত্তাব অথবা আবু জাহল বিন হিশাম এর মধ্য হতে যে তোমার নিকট অধিক প্রিয় তার দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করে দাও ।"
আনাস ইবন মালিক হতে বর্ণিতঃ তরবারী কাঁধে ঝুলিয়ে উমর চলেছেন, পথে বনী যুহরার এক ব্যক্তির ( মতান্তরে নাঈম ইবন আব্দুল্লাহ’র) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন দিকে উমর ? বললেন, মুহাম্মদের একটা দফারফা করতে। লোকটি বললেন মুহাম্মদের (সা) দফারফা করে বনী হাশিম ও বনী যুহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে ? এ কথা শুনে উমর বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে তুমিও পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছো । লোকটি বললেনঃ উমর একটি বিস্ময়কর খবর শুন, তোমার বোন ও ভগ্নীপতি বিধর্মী হয়ে গেছে। তাঁরা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে। (আসলে লোকটির লক্ষ্য ছিল উমরকে তার লক্ষ থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া।) এ কথা শুনে উমর রাগে উম্মত্ত হয়ে ছুটলেন তাঁর বোন ভগ্নীপতির বাড়ীর উদ্দেশ্যে। আবড়ির দরজায় উমরের করাঘাত পরলো। তারা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত এর কাছে কোরআন শিখছিলেন। উমরের আভাষ পেয়ে খাব্বাব তখন বাড়ীর আরেকটি কক্ষে আত্মগোপন করলেন।উমর বোন ভগ্নীপতীকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের এখানে গুনগুন আওয়াজ শুনছিলাম তা কিসের ? তাঁরা তখন কোরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন। তাঁরা উত্তর দিলেনঃ আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। উমর বললেনঃ সম্ভবতঃ তোমরা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছো। ভগ্নীপতি বললেনঃ তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে উমর ? উমর তাঁর ভগ্নীপতির উপর ঝাপিয়ে পরলেন এবং দু’পায়ে তাঁকে ভীষভাবে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাচাতে এগিয়ে এলে উমর তাকে ধরে এনে এমন মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। বোন রাগে উত্তজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ সত্য যদি তেমার দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে থাকে, তাহলে আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসুল।
তিনি তাঁর রক্ত ও সত্যের সাক্ষ্য তাঁকে এমন একটি ধাক্কা দিল, যে তাঁর সব দ্বিধা-দ্বন্ধ কর্পূরের মত উড়ে গেল। মুহূর্তে হৃদয় তাঁর সত্যে জ্যোতির উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি পাক-সাফ হয়ে বোনের হাত থেকে সূরা ত্বাহার অংশটুকু নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বললেনঃ আমাকে তোমরা মুহাম্মাদের (সা) কাছে নিয়ে চল। উমারের একথা শুনে এতক্ষণে খাব্বাব ঘরের গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেনঃ সুসংবাদ উমার! বৃহস্পতিবার রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) তোমর জন্য দোআ করেছিলেন। আমি আশাকরি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ আল্লাহ, উমর ইবনুল খাত্তাব বা আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী কর। খাব্বার আরো বললেনঃ রাসুল (সা) এখন সাফার পাদদেশে ‘দারুল আরকামে’।
উমর চললেন দারুল আরকামের দিকে। হামজা এবং তালহার সাথে আরো কিছু সাহাবী তখন আরকামের বাড়ীর দরজায় পাহারারত। উমরকে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে পরলেন। তবে হামজা সান্তনা দিয়ে বললেনঃআল্লাহ উমরের কল্যান চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসুল (সাঃ) এর অনুসারী হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য খুবই সহজ হবে। রাসুল (সা) তখন বাড়ীর ভিতরে তাঁর উপর তখন ওহী নাজিল হচ্ছিল। একটু পরে তিনি বেড়িয়ে উমরের কাছে এলেন। উমরের কাপড় ও তরবারীর হাতল তিনি মুট করে ধরে বললেনঃ উমর তুমি কি বিরত হবে না ?………তারপর তিনি দোআ করলেনঃ হে আল্লাহ, উমর আমার সামনে, হে আল্লাহ উমরের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী কর। উমর বলে উঠলেনঃ আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসুল। ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি আহবান জানালেন,ইয়া রাসুলাল্লাহ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ুন। এটা নবুয়তের ষষ্ঠ বছরের ঘটনা।
উমরের ইসলাম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। যদিও তখন পর্যন্ত ৪০/৫০জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে হযরত হামজাও ছিলেন তথাপি মুসলমানদের পক্ষে কা’বায় গিয়ে নামাজ পড়াতো দুরে কথা নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করাও নিরাপদ ছিল না। হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে এ অবস্থার পরিবর্তন হলো। তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষনা দিলেন এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে কা’বা ঘরে নামাজ আদায় করা শুরু করলেন।
সুবহানাল্লাহ
ReplyDeletePost a Comment