নাম আবু ইসহাক সা’দ, পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিক। ইতিহাসে তিনি সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস নামে খ্যাত। কুরাইশ বংশের বনু যুহরা শাখার সন্তান। মাতার নাম ‘হামনা’। পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন কুরাইশ বংশের। সা’দের পিতা আবু ওয়াক্কাস ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তাঁর অন্তিম রোগশয্যায় রাসূল সা. তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। মাতা হামনাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলৈন। তবে প্রথমতঃ তাঁর পুত্র সা’দের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে হৈ চৈ ও বিলাপ শুরু করে লেকজন জড়ো করে ফেললেন। মায়ের কাণ্ড দেখে ক্ষোভে দুঃখে হতভম্ব হয়ে সা’দ ঘরের এক কোণে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ বিলাপ ও হৈ চৈ করার পর মা পরিষ্কার বলে দিলেনঃ ‘সা’দ যতক্ষণ মুহাম্মাদের রিসালাতের অস্বীকৃতির ঘোষণা না ভেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পান করব না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসব না। মার আনুগত্যের হুকুম তো আল্লাহও দিয়েছেন। আমার কথা না শুনলে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মার সাথে তার কোন সম্পর্কও থাকবেন।’
সা’দ(রা) বড় অস্থির হয়ে পড়লেন। রাসূললের সা. খিদমতে হাজির হয়ে সব ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূললের সা. নিকট থেকে জবাব পাওয়ার পূর্বেই সূরা আল আনকবুতের অষ্টম আয়াতটি নাযিল হলঃ
‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের মেনো না।’
[আনকাবুত: ৮]
কুরআনের এ আয়াতটি হযরত সা’দের মানসিক অস্থিরতা দূর করে দিল। তাঁর মা তিনদিন পর্যন্ত কিছু মুখে দিলেন না, কারো সাথে কথা বললেন না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না। তাঁর অবস্থা বড় শোচনীয় হয়ে পড়ল। বার বার তিনি মার কাছে এসে তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তাঁর একই কথা, তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করতে হবে। অবশেষে তিনি মার মুখের ওপর বলে দিতে বাধ্য হলেঃ ‘মা, আপনার মতো হাজারটি মাও যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার ব্যাপারে জিদ করে পানাহারে ছেড়ে দেয় এবং প্রাণ বিসর্জন দেয়, তবুও সত্য দ্বীন পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ হযরত সা’দের এ চরম সত্য কথাটি তাঁর মার অন্তরে দাগ কাটে। অবশেষে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম মুসিলম তাঁর সহীহ গ্রন্থে ‘আল-ফাদায়িল’ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
সা’দের ভাই উমাইর রা. রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির কিছুদিন পরই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। ইবন খালদুন তাঁর ‘তারীখে’ উমাইরের পর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের ইসলাম গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।
আবু বকর রা. ছিলেন সা’দের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইমাম বুখারী তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘আল-মানাকিব’ অধ্যায়ে সা’দের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সা’দ বলেনঃ ইসলাম গ্রহণের পর আমি নিজেকে তৃতীয় মুসলমান হিসেবে দেখতে পেলাম। আসলে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে; কিন্তু অনেকের মতই তখন তিনি ঘোষণা দেননি। আর একথার সমর্থন পাওয়া যায় তাঁর মা’র ঘটনা এবং সূরা আনকাবুতের আয়াতটি নাযিলের মাধ্যমে। কারণ, এ আয়াতটি নবুওয়াতের চতুর্থ বছর নাযিল হয়। সম্ভবতঃ এ সময়ই তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মায়ের নিকট প্রকাশ করেন।
নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে সুলাইম গোত্রের ’আমর ইবন ’আবাসা গোপনে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখনও প্রকাশ্য দাওয়াতের অনুমতি আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। ইসলাম গ্রহণের পর ’আমর শিয়াবে আবী তালিবের এক কোণে নামায আদায় করছিলেন। কুরাইশরা প্রস্তর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তা দেখে দু’একজন মুসলমানের সাথে সা’দও এগিয়ে এলেন এবং উক্ত কুরাইশ কাফিরদের সাথে তাদের ঝগড়া ও হাতাহাতি শুরু হয়। হযরত সা’দ তাঁর চাবুকটি দিয়ে এক কাফিরকে বেদম মার দিলেন। লোকটির দেহ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। কোন মুসলিমানের হাতে কোন মুশরিকের রক্ত ঝরানোর এ ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম।
মুসয়াব ইবন ’উমাইর(রা)ও ইবন উম্মে মাকতুমের(রা) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর যে চার ব্যক্তি মদীনায় হিজরাত করেন তাঁদের একজন সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস(রা)। সহীহ বুখারীতে বারা ইবন আযিব থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ ‘সর্বপ্রথম আমাদের নিকট আগমণ করেন মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম। এ দু’ব্যক্তি মদীনাবাসীদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। অতঃপর বিলাল, সা’দ ও আম্মার বিন ইয়াসির আগমন করেন। ইবন সা’দ ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, সা’দ ও তাঁর ভাই উমাইর মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় এসে তাদের অন্য এক ভাই ’উতবা ইবন আবী ওয়াক্কাসের নিকট অবস্থান করেন। তার কয়েক বছর পূর্বেই ’উতবা এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় নেয়।
আল্লাহর পথে জিহাদে সা’দের(রা) ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা ইসলাম-দুশমনদের খুব মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তিনিই প্রথম মুসলিম যিনি আল্লাহর পথে তীর নিক্ষেপ করেন। তিনি নিজেও বলতেন,
– ‘আমি প্রথম আরব যে আল্লাহর জন্য তীর চালনা করেছিল।’.
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর বেশ কিছুকাল যাবত মুহাজির মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। তাদের না ছিল খাদ্য সম্ভার, না ছিল পরিধেয় বস্ত্র এবং না ছিল সুনির্দিষ্ট জীবিকার উপায় উপকরণ। মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের চাপে মদীনায় সীমিত পরিসরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিতটি নড়ে উঠেছিল। মদীনার আনসার-মুহাজির নির্বিশেষে গোটা মুসলিম সমাজ চরম আর্থিক দুর্গতির মধ্যে নিপতিত হয়। এমন চরম দারিদ্রের মধ্যে তাঁরা ইসলামের প্রচার প্রসারের কাজ জারি রাখেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁদের এ চরম দারিদ্র সম্পর্কে হযরত সা’দ বলেনঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম; অথচ তখন গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার কিছুই থাকতো না। (তা খেয়েই আমরা জীবন ধারণ করতাম) আর আমাদের বিষ্ঠা হত উট ছাগলের বিষ্ঠার মত।’- (বুখারী ও মুসলিমঃ মানাকিবু সা’দ রা.)
হিজরাতের এক বছর পর সফর মাসে রাসূল সা. ষাটজন উষ্ট্রারোহীর একটি দলকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে টহল দিতে পাঠালেন। এ দলে সা’দও(রা) ছিলেন। এক পর্যায়ে ইকরিমা ইবন আবী জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশদের বিরাট একটি দল তাঁরা দেখতে পেলেন। কিন্তু উভয় পক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে গেল। তবে কুরাইশ পক্ষের কেউ একজন হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে হযরত সা’দ সাথে সাথে তীর নিক্ষেপ করলেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে কাফিরদের প্রতি নিক্ষিপ্ত প্রথম তীর।
হিজরী দ্বিতীয় সনের রবিউস সানী মাসে রাসূল সা. দু’শো সাহাবীকে সংগে নিয়ে মদীনা থেকে বের হলেন। উদ্দেশ্য, মদীনার আশে পাশে দুশমনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং দুশমনদের জানিয়ে দেওয়া যে মুসলমানরা ঘুমিয়ে নেই। এ বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন হযরত সা’দ রা.। বাওয়াত নামক স্থানে কুরাইশদের সাথে এবার ছোট খাট একটি সংঘর্ষও হয়। এর ছয়মাস পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
বদর যুদ্ধের অল্প কয়েকদিন আগে রাসূল সা. কুরাইশ কাফিলার সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিন জনের যে দলটি পাঠান তাদের একজন ছিলেন সা’দ রা.। তাঁরা বদরের কূপের নিকট ওৎ পেতে থেকে প্রতিপক্ষের দু’জনকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে আসেন। রাসূল সা. তাঁদের নিকট থেকে শত্রু পক্ষের অনেক তথ্য অবগত হন।
বদরে সা’দ ও তাঁর ভাই ’উমাইর রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে লড়েন। প্রত্যেকেই একাধিক আল্লাহর শত্রুকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠান। এ যুদ্ধে হযরত ’উমাইর রা. শাহাদাত বরণ করেন। এবং সা’দ রা. সাঈদ ইবন আ’সকে হত্যা করে তার তলোয়ারখানি নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট সমর্পণ করেন। তিনি রাসূলের সা. নিকট তলোয়ারখানি পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জবাবে তিনি বললেনঃ এ তলোয়ার না তোমার না আমার। সা’দ রাসূলের সা. নিকট থেকে উঠে কিছুদূর যেতে না যেতেই সূরা আনফাল নাযিল হয়। অতঃপর রাসূল সা. তাঁকে ডেকে বলেনঃ ‘তোমার তলোয়ার নিয়ে যাও।’
উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদরের এক বছর পর। সা’দ(রা) এ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কতিপয় মুসলিম সৈনিকের ভুলের কারণে নিশ্চিত বিজয় যখন পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়, তখন মুষ্টিমেয় যে ক’জন সৈনিক নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসূলকে সা. ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন, সা’দ রা. ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ইমাম বুখারী এ ঘটনা সা’দের রা. যবানেই বর্ণনা করেছেনঃ
’উহুদের দিনে রাসূল সা. তাঁর তুনীর আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন এবং বললেনঃ
তীর মার! আমার মা-বাবা তোমার প্রতি কুরবান হোক।’ ইবন সা’দ আরও বলেছেনঃ ‘ঘটনাক্রমে একটি তুনীর ফলা ছিলনা। সা’দ রা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ এটাতো খালি। বললেনঃ ওটাও ছুঁড়ে দাও।’
সা’দের(রা) এক ভাই ’উমাইর বদর যুদ্ধে শহীদ হন। উহুদের যুদ্ধে সা’দ রা. যখন কাফিরদের প্রবল আক্রমণ থেকে রাসূলকে সা. হিফাজতের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে লড়ছেন, ঠিক তখনই তাঁর অন্য ভাই নরাধম ’উতবার নিক্ষিপ্ত প্রস্তরাঘাতে প্রিয় নবীর মুখ আহত হয় এবং একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। সা’দ রা. প্রায়ই বলতেনঃ কাফিরদের অন্য কাউকে হত্যার এত প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না যেমন ছিল ’উতবার ব্যাপারে। কিন্তু যখন আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনলাম, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের চেহারা রক্ত-রঞ্জিত করেছে, তার ওপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে, তখন তার হত্যার আকাঙ্ক্ষা আমার নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং আমার অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে।
উহুদের যুদ্ধে তিনি এক অস্বাভাবিক দৃশ্য অবলোকন করেন। তিনি বলেনঃ ‘উহুদের দিন আমি রাসূলুল্লাহর সা. ডানে ও বামে ধবধবে সাদা দু’ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। কাফিরদের সাথে তারা প্রচণ্ড লড়ছে। এর আগে বা পরে আর কখনও আমি তাদেরকে দেখিনি।’
খন্দকের যুদ্ধ হয় উহুদের দু’বছর পর। এ যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধে সালা পর্বতের এক উপত্যকায় রাসুলের সা. জন্য একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়। এক ঠাণ্ডার রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে রসূল সা. একাকী শুয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেলেন্। জিজ্ঞেস করলেনঃ কে? উত্তর পেলেনঃ সা’দ- আবী ওয়াক্কাসের পুত্র। কি জন্য এসেছ? বললেনঃ সা’দের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্ধকার ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হল। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি।
______
[তথ্যসূত্র: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ]
আমরা সেই সে জাতি এটা কি বই?
ReplyDeleteসুবহানাল্লাহ অসাধারণ।
ReplyDeletePost a Comment