নাম তাঁর তুফাইল। ‘যুন-নূর’ উপাধি। ‘দাওস’ গোত্রের সন্তান হওয়ার কারণে দাওসী বলা হয়। তাঁর কবীলা(গোত্র)-দাওস ইয়ামনে বসবাসকালী একটি শক্তিশালী গোত্র। তিনি ছিলেন এ গোত্রের ‘রয়িস’ বা সরদার। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাঁর পেশা। এ কারণে মাঝে মধ্যে তাঁকে মক্কায় আসা-যাওয়া করতে হতো।
তুফাইল ছিলেন জাহিলী যুগের আরবের সম্ভ্রান্ত ও আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। তাঁর চুলো থেকে হাঁড়ি কখনো নামতো না। অতিথির জন্য তাঁর বাড়ীর দরজা থাকতো সর্বদা উন্মুক্ত।
তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সহজাত কাব্য প্রতিভা ও সূক্ষ্ণ অনুভূতির অধিকারী। ভাষার মধুরতা, তিক্ততা ও ভাষার ইন্দ্রজাল সম্পর্কে তিনি ছিলেন সুবিজ্ঞ।
একবার তুফাইল ইবন ’আমর ব্যবসা উপলক্ষে তাঁর গোত্রের আবাসস্থল তিহামা অঞ্চল থেকে মক্কায় উপস্থিত হলেন। মক্কায় তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। দু’টি দলই নিজ নিজ মতের সমর্থক সংগ্রহে তৎপর। একদিকে রাসূল (ﷺ) আহ্বানে জানাচ্ছেন মানুষকে তাঁর প্রভূর দিকে। অন্যদিকে কাফিররা সব ধরণের উপায়-উপকরণ প্রয়োগ করে মানুষকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বলা চলে, তিনি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেতভাবে এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেন। কারণ, তিনি তো এ উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেননি। ইতিপূর্বে মুহাম্মাদ(ﷺ) ও কুরাইশদের এ দ্বন্দ্বের কথা তাঁর মনে একবারও উদয় হয়নি। এ সংঘাতের সাথে তাঁর জীবনের এক অভিনব কাহিনী জড়িত আছে। তিনি বলেন,
.
‘'আমি মক্কায় প্রবেশ করলাম। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে সর্বোত্তম সম্ভাষণে আমাকে স্বগত জানালো। আমাকে তারা তাদের সর্বাধিক সম্মানিত বাড়ীতে আশ্রয় দিল। তারপর তাদের নেতৃবৃন্দ ও জ্ঞানী-গুণীরা আমার কাছে এসে বললোঃ ‘তুফাইল, আপনি এসেছেন আমাদের এ আবাসভূমিতে। এ লোকটি, যে নিজেকে একজন নবী বলে মনে করে, আমাদের সকল ব্যাপারে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে। আমাদের ভয় হচ্ছে, আপনিও তার কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে পড়েন এবং আপনার নেতৃত্বে আপনার গোত্রেও আমাদের মত একই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে। সুতরাং আপনি এই লোকটির সাথে কোন রকম আলাপ-আলোচনা করবেন না, তার কোন কথায় কান দেবেন না। কারণ, তার কথা যাদুর মত কাজ করে। সে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয় পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।’'
তুফাইল বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তারা আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে অভিনব কাহিনী ও তাঁর নানা রকম আশ্চর্য কার্যাবলী বর্ণনা করে আমাকে ও আমার গোত্রকে সতর্ক করে দিল। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁর কাছে আমি ঘেঁষবোনা, তাঁর সাথে কথা বলবো না বা তাঁর কোন কথাও শুনবো না। সে সময় আমরা কা’বার তাওয়াফ করতাম এবং সেখানে রক্ষিত মূর্তিসমূহের পূজাও করতাম। যখন আমি কা’বার তাওয়াফ ও মূর্তি পূজার জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম, আমার দু’কানে ভালো করে তুলো ভরে নিলাম যাতে কোনভাবেই মুহাম্মাদের (ﷺ) কথা আমার কানে প্রবেশ করতে না পারে।
মাসজিদুল হারামে ঢুকেই আমি দেখতে পেলাম তিনি কা’বার পাশেই নামাযে দাঁড়িয়ে। তবে তাঁর সে নামায আমাদের নামাযের মত ছিল না, তাঁর সে ইবাদাত আমাদের ইবাদাতের মত ছিল না। এ দৃশ্য আমাকে পুলকিত করলো, তঁঅর সে ইবাদাত আমাকে আন্দোলিত করলো। আমার ইচ্ছে হলো তাঁর নিকটে যাই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক পা দু’পা করে তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। আল্লাহর ইচ্ছে ছিল তাঁর কিছু কথা আমার কানে পৌঁছে দেয়া। তাই, কানে তুলো ভরা সত্ত্বেও তাঁর কিছু উত্তম বাণী আমি শুনতে পেলাম। মনে মনে বললামঃ ‘'তুফাইল, তোর মা নিপাত যাক, তুই একজন বুদ্ধিমান কবি। ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা তোর আছে। এ লোকটির কথা শুনতে তোর বাধা কিসে? যদি সে ভালো কথা বলে, গ্রহণ করবি, আর মন্দ হলে প্রত্যাখ্যান করবি।’'
তুফাইল বলেন, আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। নামায শেষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন। আমিও তাঁকে অনুসরণ করে তাঁর বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলাম। বললামঃ ইয়া মুহাম্মাদ(ﷺ) , আপনার কাওমের লোকেরা আপনার সম্পর্কে এইসব কথা আমাকে বলেছে। তারা আমাকে আপনার সম্পর্কে এত ভয় দেখিয়েছে যে আপনার কোন কথা যাতে আমার কানে ঢুকতে না পারে সেজন্য আমি কানে তুলো ভরে নিয়েছি। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা আপনার কিছু কথা না শুনিয়ে ছাড়লেন না। যা শুনেছি, ভালোই মনে হয়েছে। আপনি আপনার ব্যাপারটি আমার কাছে একটু খুলে বলুন। তিনি তাঁর বক্তব্য সুষ্ঠুভাবে বলার পর সূরা ইখলাস ও সূরা আল-ফালাক তিলাওয়াত করে আমাকে শুনালেন। সত্যি কথা বলতে কি, এর থেকে সুন্দর কথা ও অনুপম বিষয় আর কখনো আমি শুনিনি। সেই মুহূর্তে আমার হাত তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম এবং কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ [আল্লাহ ছাড়া সত্য উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ(ﷺ) আল্লাহর রাসুল] পাঠ করে ইসলামের ঘোষণা দিলাম ।
তথ্যসূত্র: "আসহাবে রাসুলের জীবনকথা"
Post a Comment